Saturday, August 16, 2008

গরুমারা জঙ্গল :



গতবছর হঠাৎ আমার কর্তা এসে বলল যে প্রত্যেক বছর পুজোয় তো কলকাতাতে থাকি, এই বছর একটু অন্যরকম ভাবে কাটালে কেমন হয়! যেই না বলা, ওমনি আমার সামনে ভেসে উঠল আবার জঙ্গল-পাহাড়ের মন কাড়ানো চেনা ছবি । ব্যাস শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়। প্রথমত কোথায় যাব আর দ্বিতীয়ত কবে যাব? ঠিক হল দশমীর রাত্রে বেড়োনো হবে, আর জায়গা ঠিক হল খুব কাছেই উত্তরবঙ্গ। আমার বড় প্রিয় জায়গা গরুমারা’র জঙ্গল।

পুজোর নবমী কেটে যেতেই মনের মধ্যে দশমীর বেদনার সুর না বেজে, বাজলো মাদলের বোল। রাত্রি ১০.০৫ এর দার্জিলিং মেল এ চড়ে বসলাম। আমরা দলে ছিলাম ৭ জন। পরদিন সকালে পৌঁছালাম নিউ জলপাইগুঁড়ি স্টেশনে। সেখানে বিষ্ণু (আমাদের চেনা লোকাল ড্রাইভার) আমাদের জন্য গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। স্টেশন ছেড়ে জলপাইগুঁড়ি শহর ছাড়িয়ে মালবাজার পেরিয়ে চললাম। দুপাশে মাইলের পর মাইল ফাঁকা। ঘন্টা দেড়েক চলার পর জঙ্গলের দেখা মিলল। বেলা ১০ টা নাগাদ আমরা গিয়ে পৌঁছালাম ডবলিউ.বি.এফ.টি.ডি.সি(W.B.F.T.D.C)’র বাংলো বনানী’তে। দেখতে অপূর্ব বাংলো’টি প্রত্যেকটি ঘর এক একটি নদীর নামে। তিস্তা, মুর্তি, তাপ্তি, তোর্সা, সুপ্তি, জলঢাকা –এইরকম। অনেকক্ষণ ধরে একটা জলের বয়ে চলার আওয়াজ আমাদের কানে আসছিল,কিন্তু কোথা থেকে তা বুঝতে না পারায় ওখানকার ম্যানেজার মিস্টার চক্রবর্ত্তী’কে জিজ্ঞাসা করলাম। উনি একটু হেসে বললেন “গিয়েই দেখুন না..”আমরা অত্যন্ত কৌতুহলের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়াতেই অপূর্ব দৃশ্য। প্রবহমান মুর্তি তার নিজের গতিতে বয়ে চলেছে। তার একপাশে আমাদের বাংলো আর একপাশে গরুমারা’র জঙ্গল। কেউ আর বেশী অপেক্ষা না করে কোনরকমে পোশাক বদলে চললাম জলের উদ্দেশ্যে। বাংলো থেকে বাগান পেরিয়ে একটা পাথুরে রাস্তা, সেটাই চলে গিয়েছে সোজা নদীর দিকে। জলের গভীরতা বেশী না হলেও সকালে বৃষ্টি হওয়ার জন্য নদী’তে স্রোত ছিল ভালোই। প্রায় ২ঘন্টা সেখানে কাটালাম, জল ছেড়ে উঠতে কারোর-ই ভালো লাগছিলো না। সমুদ্রে স্নান করার অভিজ্ঞতা কম বেশী সবার’ই আছে, কিন্তু পাহাড়ী নদীতে কখন’ই ছিলো না।

দুপুরে সবাই খুব পরিশ্রান্ত থাকায় একটু বিশ্রামের পর বিকাল ৪’টের সময় গেলাম ‘যাত্রাপ্রসাদ ওয়াচ্ টাওয়ার’। অনুমতি (permit)আগে থেকেই বাংলোর ম্যানেজার করে রেখেছিলেন। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম নানা রকমের ঝিঁঝিঁ’র ডাক,কোনটা চেনা আবার কোনটা অচেনা। হঠাৎ পুজোর ঘন্টার মতো একটা আওয়াজ শুনে গাইড’কে জিজ্ঞেস করায় সে বলল যে ওটা নাকি একরকমের ঝিঁঝিঁ পোকা। অবশেষে ওয়াচ্ টাওয়ার এ পৌঁছালাম । ওখানে বসার বন্দোবস্ত ছিল। দূরে দেখলাম একটা জায়গায় একটা ছোট জলাশায়, সেখানে জলের মধ্যে নুন দেওয়া,বন্য জন্তুরা ওখানে নুন খেতে আসে। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে অপেক্ষা করার র বেশ কিছু বাইসন, প্রচুর ময়ূর, গন্ডার, শিং-ওয়ালা হরিণ দেখলাম। রাত্রে বাংলোর পাশে খোলা আকাশের নীচে আগুন জ্বেলে অধিবাসীদের নাচ দেখলাম। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। মনে হল যেন সত্যি কোনো অধিবাসী’দের গ্রামে বসে আছি।

পরের দিন রওনা হলাম ঝালং-বিন্দুর উদ্দেশ্যে। এখানে রাস্তার একপাশে পাহাড় আর একপাশে নদী। জলঢাকা নদী প্রায় অর্ধেক রাস্তা আমাদের সাথে চলল। অবশেষে পৌঁছালাম বিন্দুতে। এটাই পশ্চিমবঙ্গের শেষ সীমানা, তাই এর নাম বিন্দু। একদিকে ইন্ডিয়া আর একদিকে ভুটান। জলঢাকা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি এখানেই। জলঢাকা নদীতে বাঁধ দিয়ে এটি তৈরী করা হয়েছে, সে এক বিরাট ব্যাপার। বাঁধের জল ছাড়া দেখার মতো। প্রায় ১০০ফুট ওপরেও জল এসে আমাদের গায়ে ছিটছে। এখানে বর্ডার বলে নিরাপত্তার বেশ কড়াকড়ি, ছবি তোলাও নিষেধ। ভুটানের পাহাড়ের দিকে পায়ে পায়ে বেশ কিছুদূর এগিয়েও ফিরে আসতে হলো নিরাপত্তার জন্য। এখানে তিনটে নদী এসে মিলেছে জলঢাকা, বিন্দু ও কেদো । জলঢাকার জল স্বচ্ছ, বিন্দুর জল সবুজ, আর কেদোর জল ঘোলা। অদ্ভুত ব্যাপার হল নদী ৩টে এক সাথে মিললেও তাদের’কে আলাদা আলাদা করে চেনা যায়।

ফিরে এলাম দুপুরে। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে রাত্রে জঙ্গল দেখার ব্যবস্থা করা হলো, যা নিয়মের বাইরে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা ছাড়া খুব কষ্টকর। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা বেড়োলাম গাইড’কে সাথে নিয়ে। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, ঘন জঙ্গল, শুধু গাড়ীর আলো ছাড়া চারিদিকে চাঁদের আলো। নানারকম পাখির ডাক। মনের মধ্যে যে ভয়ও করছিলো না, এ কথা বলব না, কিন্তু সব কিছু’কে ছাপিয়ে চারিদিকে তখন শুধু জঙ্গলের গন্ধ। ঘন্টা দেড়েক এভাবে ঘুরলাম, ফেরারও ইচ্ছে ছিলো না, তাও ফিরতে হলো। পরদিন ফিরে আসার পালা।

সকালে উঠে পায়ে হেঁটে সবাই মিলে বেশ কিছুটা ঘুরে এলাম। মন সবার’ই খুব খারাপ। সবুজ ছেড়ে আবার সেই ধুলো, ধোঁয়া’র মধ্যে ফিরে যেতে হবে বলে, কিন্তু নিরুপায়। তাই আবার আসার প্রতিক্ষা নিয়ে দার্জিলিং মেল এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।





লেখিকা : সোমা ব্যানার্জী
৩১শে জুলাই, ২০০৮
কোলকাতা, ইন্ডিয়া

9 comments:

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Oshadharon Bornona..
Mon hariye giyechhilo toder shangei.

Shraddha.

Sharmila Dasgupta said...

khub shundor description...tourism er office khule felteparish ebar...:)

Anonymous said...

khub sundor hoyechhe lekhata arr tar songe chhobi gulo

Asim said...

Priya soma,
Garumaaraa jangal ebang taar aashepaasher barnanaa diye tomaader bhraman brittaanta daarun sundar bhabe saajiyechha. Aami erakam lekhaai dekhte chaai tomaader kaachh theke. Sahaj saral bhangite nijer dekha, anubhuti, bhab bhaalobaasaa sab phute uthbe. Taar madhye diyei thakbe jaigatir katha. Ei saber adbhut sundar sangmishran ghatiyechha tumi. Aasha kori sabaar bhalo laagbe. Aar chhabigulor janye lekhati aaro bhalo legechhe.

Subhashis said...

soma, aapni khub e pranochhal barnona diyechhen. lekha rmadhye ekta uchchhas rayechhe, jeta berabar samay aapnader anondo o utsaher porichay dichhe.

bhalo laglo pore

Soma Banerjee said...

sobai ke onek onek dhonyobaad

jhum said...

soma darun laglore tor bhromon kahini. khanikta jeno golpo sunlam ar khanikta jaigar bornona. tai ektuo boring mone hocchilona tor lekhar jonnei aro ujjwol laglo bornonata. vison valo hoyeche.

Unknown said...

soma tomar lekha porlam o chhobio dekhlam.jungle,nodi,pahar sob milie amader uttarbongo porjotokder khub pochhonder jaiga mone holo.amar edikta jabar ichhata tumi aro barie dile.sujog pelei kodiner jonya harie jabo sobuje majhe.........

hamid kaisar blogh said...

bhalo lekhesen boudhi, akhon je jete ichse korse sekhane. korbota ki!