Tuesday, August 12, 2008

হিমালয়ের হাতছানি :


হোলির দিন সবাই যখন আবীর আর রঙ খেলায় মেতে উঠেছে, আমরা তখন আমাদের ভ্রমন কতটা রোমাঞ্চকর হবে ভাবছি। অবশেষে আমরা স্যাক কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম ২৪ শে মার্চ। এখানে এসেই আমার ভীষন আনন্দ হল, সুদীর্ঘ ১৪ মাস পর বাংলায় পা রাখলাম। আর দেখতে পাব সুন্দরী 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'। যাই হোক, আমরা টিম লিডার দেবুদার সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর একে একে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব সেরে ফেললাম। আমাদের সাড়ে ১৪ জনের দল নিয়ে ২ টি গাড়ি রওনা দিল। আগামী গন্তব্য মিরিক। পথের দুপাশে চা'বাগান সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। আমরা যত এগচ্ছি আবহাওয়া ততই খারাপ হচ্ছে। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর মিরিক শহরে পৌঁছলাম। এখানেই একটা রেস্টুরেন্টে আমরা লাঞ্চ করে নিলাম। খাবার পর বেশ শীত করছিল। কাঁপতে কাঁপতেই আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়ির কাঁচ তোলা থাকায় আর ঠাণ্ডা লাগল না। দেবুদা সবাইকে বলে দিলেন বাইরে চোখ রাখতে, কিছুটা গিয়েই দেখলাম টল টল করছে মিরিক লেক। চারদিকে গাছ ঘেরা। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিল মেঘের আড়ালে। বেশ কিছু পযর্টক প্যাডেল বোট চালাচ্ছে। আমরা গাড়ি থেকেই দেখে নিলাম, ছবিও উঠল। পাহাড়ি ছেলেমেয়ে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছে হইহই করে। বেশ ভাল লাগল জায়গাটা। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম 'মানেভঞ্জন'। এখানে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, সঙ্গী হবে ল্যান্ডরোভার। এই গাড়িটির নাম পড়েছি, কিন্ত চোখে দেখলাম প্রথমবার। গাড়িটির ইঞ্জিন ১৯২৫ সালে তৈরি। পাহাড়ি রাস্তায় এই গাড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে যায়, গতি ৪ কিমি/ঘঃ। এদিকে আকাশ তখন ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে ,টিপ টিপ করে বৃস্টি পড়ছে, আর ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে। এটি একটি ছোট জনবসতি, কিছু্‌ দোকানপাট রয়েছে। ট্রেকারসরা এখান থেকেই জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটা শুরু করে। আমাদের মধ্যে কয়েকজন হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। আমাদের আর সে সুযোগ দিল না দেবুদা। আমরা ল্যান্ডরোভারে চেপে বসলাম। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। পাহাড়ি রাস্তায় লাফাতে লাফাতে চলেছে, তবে এই রাস্তা হেঁটে গেলেও মন্দ হত না। এই যানটি চাপার সৌভাগ্য আর হবে কি না হবে, তাই এতে চেপেই আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম 'চিত্রে'। পাহাড়ে ঘেরা একটা জায়গা, গাছপালাও কম। অদূরে দেখলাম কয়েকটা ঘর রয়েছে। তারপর জানলাম আজকের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা এখানেই। নামটাও কিন্তু দারুণ!!!! " Hawk's nest". চোদ্দজনের দল তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে তিনটি ঘরে রইল। দুদিন রাস্তার ধকল কাটিয়ে একটু বিশ্রামের জন্য হাত মুখ ধুয়ে শরীরটাকে ছড়িয়ে দিলাম পাঁচ মিনিট। তার পর চায়ের সাথে খানিক আড্ডা হল। এখানে সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়েছে, তাতে বাতিও জ্বলছে, টিভিও চলছে। রাতের খাবার এসে গেল নটার আগেই। ডাল, ভাত, আলুভাজা, পাপড়, স্যালাড আর ঘরে তৈরী আচার। আয়োজন সামান্য হলেও আমরা তাই চেটেপুটে খেলাম। এদের আতিথেয়তা,আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করল। সেই রাতে অত ক্লান্তির পরেও একটুও ঘুম এল না। উচ্চতা জনিত কারণে এবং এক সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতার জন্য সারারাত জেগে কাটলো।

এখানে খুব তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে যায়। সবাই তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে নটার সময় যাত্রা শুরু করলাম। আজকের গন্ত্যব্য ৬ কিমি দুরের টংলু। যাত্রার শুরুতেই সবাই একটা করে লাঠি নিয়ে নেওয়া হল। নিজেদের সব লাগেজ গাড়িতে তুলে দেওয়া হল। নিজের সাথে জল,বিস্কুট,চকলেট ইত্যাদি নিলাম। প্রথমে এক কিমি রাস্তা বেশ ভাল, তারপর চড়াই শুরু হল তবে সেরকম কঠিন নয়। পথে যেতে যেতেই দেখলাম গোলাপি গুরাশ ফুটে রয়েছে। আর দেখলাম সাদা পদ্ম ফুলের মত ম্যাগনোলিয়া। এই সব দেখতে দেখতেই আমরা এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে ফটো তোলাও চলতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মেঘমা এসে পৌঁছলাম। এখানে কিছু চোরতেন চোখে পড়ল। এখানে জাপানিদের একটা স্কুল দেখলাম। কেউ কেউ চা খেয়ে একটু জিরিয়ে নিল। তখনি শুনলাম যে দলের দুজন পথ হারিয়ে নেপালে ঢুকে পড়েছিল। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার জীপ রাস্তা ছেড়ে চড়াই বেয়ে উঠতে সুরু করলাম। কিছুটা যাবার পর পর নজর রাখলাম সঙ্গীদের দিকে। হঠাৎ মনে হল অনেকটা পথ এসে গেছি, কাছাকাছি কাউকেই দেখতে পারছি না। আমার সংগে আছে টুপুর। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। চারপাশে উঁচু পাহাড় ঘিরে আছে আর ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে। মনে হল এই বুঝি আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। দুর থেকে দেখলাম দেবুদা আসছে। তখন আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর জীপের রাস্তা ধরলাম। কিছুটা যাবার পরই কয়েকজন স্থানীয় মানুষ চোখে পড়ল। তার মানে আমি পৌঁছে গেছি টংলু। টংলুর উচ্চতা ১০০৯৮ ফুট। আমরা আজ থাকব ট্রেকারস্ হাট এ। ট্রেকারস্ হাটের অবস্থান এমন জায়গায় যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে খুব ভাল দেখা যায়। কিন্তু এখন আকাশ মেঘলা যেকোন সময় বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা ,তাই কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চার ঘন্টা হাঁটার পর পেটে ছুঁচোবাজি শুরু হয়ে গেছে। এদিকে দেবুদা ডাকাডাকি করছে সবাইকে স্ট্রেচিং করার জন্য, তা না হলে পরের দিন হাঁটা যাবেনা। ১০-১৫ মিনিট করতে হল। তারপর আমরা লাঞ্চ করলাম। পেটে এত ক্ষীদে তখন ডাল-ভাত অমৃত সমান। তখন দেখলাম বাইরে এক বিদেশী দল তাঁবু খাটাচ্ছে। এখানে থাকার জায়গা না পেলে আমাদেরও ঐভাবে থাকতে হত, তাই সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে এখানে আসতে হয়। হাওয়ার দাপট ক্রমশ বাড়ছে, সঙ্গে বৃষ্টি ও শুরু হয়েছে। ভাবলাম চারপাশটা একটু ঘুরে দেখব, তা আর যাওয়াহল না। ঘরের মধ্যেই আড্ডা বসল। রাত বাড়ার সঙ্গে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। সোয়েটার জ্যাকেট,টুপি,মোজা সবকিছু ভেদ করে ঠান্ডা ঢুকছে। আমাদের আড্ডার সঙ্গে চলল চা-মুড়ি খাওয়া। গল্পে-গানে কোথা দিয়ে যেন সময় কেটে গেল। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কেউ কেউ স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল। কিন্তু সারারাত ঠান্ডায় আমার দুচোখের পাতা এক হল না। বাতাসের শব্দ শুনে আর শীতের কামড় খেয়ে রাত কাবার হল। পরদিন সুর্য্য ওঠার আগেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। কিন্তু ক্যামেরা ধরব কি করে, ঠান্ডায় তো হাত জমে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে অন্ধকারসরে পুব আকাশে আবির খেলা সুরু হচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু, পান্ডিম, একে একে দেখা যাচ্ছে। সূর্য্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে হিমালায়ের শৃঙ্গ গুলোর উপরে। এ এক অন্য সকাল! দিনের সূচনা যে এত সুন্দর হয় এর আগে আমার জানা ছিল না। কাঞ্চনজঙ্ঘার সে কি রূপ ! মনে হচ্ছে কোন মহাপুরুষ নিদ্রিত আছেন। তাই এই কাঞ্চনজঙ্ঘা স্লিপিং বুদ্ধ নামে পরিচিত। প্রচন্ড ঠান্ডা আর ঝোড়ো হাওয়ায় কাঁপুনি দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বেশ কিছু ছবি নিলাম। তারপর চা খেয়ে শরীর একটু গরম হল । টংলুর ভোর আমার এক পরম প্রাপ্তি।

আজ আমাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হবে এবং এই পথ বেশ দূর্গম । আজ ১৪ কিমি হাঁটতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করলাম। এই পথটা আরো বেশী সুন্দর। যত এগোতে লাগলাম লাল গুরাস আর ও নাম না জানা পাহাড়ি ফুল দেখতে পেলাম। ১ কিমি গিয়েই টুমলিং। এখানেও টেক্রারস রা থাকতে পারে ,ব্যবস্থা আছে। আমরা এখানে সময় নষ্ট না করে এগিয়ে চললাম। কিছুটা যাবার পর দেখলাম গাছপালা একদম কম, চারদিকে শুধু খাড়া পাহাড়। এরপর পুরো রাস্তাটাই সিঙ্গালিলা ন্যাশানাল পার্ক এর অন্তর্ভূক্ত। হঠাৎ আমাদের মুভি ক্যামেরা গরবর করল, মনে হচ্ছে ঠান্ডার জন্য অথবা ময়স্চার ঢুকে গেছে। আপাতত ছবি তোলা বন্ধ রেখে হাঁটা দিলাম। ততক্ষণে দেবুদা এসে গেছে, আমাদের তাড়া দিল। বলল ৩ কিমি গিয়ে 'গৈরিবাস' থেকে ২৫ টাকা দিয়ে পার্কে প্রবেশ করা যাবে। যত যাচ্ছি রাস্তা তত খারাপ হচ্ছে। চারদিকে অনেক ম্যাগনোলিয়া ফুটে আছে। গাছগুলোয় পাতা নেই, ফুলে ভরে আছে শুধু। পথের সৌন্দর্য্য ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছে। আমরা কখনো নেপাল আবার কখনো ভারতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। গৈরিবাসে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প রয়ছে। ইতিমধ্যে ক্যামেরাকে একটু রোদ খাওয়াতেই ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু ক্যামেরা চালানোয় ধমক খেলাম। এখান থেকে কয়েকজন গাড়িতে উঠে গেল, আমার মেয়ে টুপুর ও উঠে গেল। আমি আর আমার হাজব্যন্ড হাঁটা শুরু করলাম। এবার পুরো রাস্তাটা চড়াই। আমরা জিপের রাস্তা ছেড়ে দেবুদার চিহ্নিত পথ ধরে চলেছি। এপথ আমি কোনদিন ভুলব না। পুরোটাই ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে। বুনো গন্ধ গায়ে মেখে শুকনো পাতার খসখসানি শুনতে শুনতে চলেছি। একটু করে দম নিচ্ছি আর এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে নাম না জানা পাখীর মিষ্টি গান কানে আসছে। কিছুটা চড়াই পেরিয়ে জিপ রাস্তা ধরলাম। ঘন্টাখানেক পর আমরা কৈয়াকাটা পৌঁছলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে আবার এগোলাম। চা টা দারুন বানিয়েছিল, শরীরটা বেশ চাঙ্গা হল। আমাদের আরো ২ কিমি যেতে হবে। তাড়াতড়ি পা চালালাম। আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আমি টুপুরের হাত ধরে দ্রুত পা চালালাম।আর থামা নয় সোজা রাস্তা, হারাবার ভয় নেই। এদিকে প্রচুর ক্ষিদে পেয়ে গেছে। আবার শীত ও করছে। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। দূর থেকে ১টা পুকুর চোখে পড়ল আর অনেক প্রেয়ারস্ ফ্ল্যাগ। নেপালি ভাষায় পোখরি মানে পুকুর। এই পুকুরের জল কালো রঙের, তাই এজায়গার নাম শুনেছি 'কালাপোখরি'। আজ আমরা থাকব 'কালাপোখরির পান্ডিম লজে'।

আজকের রাতটা একটু ঘুমোতে পারলাম। আগের দুরাত না ঘুমিয়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। পরদিন চারপাশটা ঘুরে দেখে নিলাম। তারপর যাত্রা শুরু হল সান্দাকফুর দিকে। আজ রাস্তা বেশ কঠিন তবে দীর্ঘ নয়। চার কিমি দুরে বিকেভঞ্জন অবধি রাস্তা বেশ ভাল। তারপর থেকে শুরু হচ্ছে দুরুহ চড়াই। তবে পথটা ভীষণ সুন্দর। ধীরে ধীরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হচ্ছে। নানা ধরণের গুরাশ,পাইন,ফার দৃশ্যমান হচ্ছে। যেতে যেতে আরও দুই বাঙ্গালির সাথে দেখা। তারাও সান্দাকফু যাচ্ছে। ৩কিমি চড়াই অতিক্রম করে সান্দাকফু এসে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছে বাকরূদ্ধ হয়ে গেলাম। এখন আমি পশ্চিমবঙ্গের সর্ব্বোচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। এই সেই জায়গা যেখান থেকে একমাত্র এভারেষ্ট,কাঞ্চনজঙ্ঘা,লোটসে,পান্ডিম একসাথে এতগুলো শৃঙ্গ দেখা যায়। এখানে থাকার জায়গা বেশ কয়েকটি আছে। আমরা আজ থাকব 'শেরপা শ্যালেতে'। এখন আকাশ মেঘলা, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে সূর্য্য উঁকি মারছে। তখন দেবুদা আমাদের শৃঙ্গগুলির অবস্থান দেখিয়ে দিল। আমি তো পরের দিন ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেদিনের সন্ধ্যাটা গল্পে গানে বেশ কেটে গেল।পরদিন তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে বাইরে এলাম। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা আর তেমনি হাওয়া। ধীরে ধীরে আকাশে হোলি খেলা শুরু হল। একে একে এভারেষ্ট,কাঞ্চনজঙ্ঘা,লোটসে আলোকছটায় রঞ্জিত হল। সে এক অতুলনীয় দৃশ্য, যা ভাষায় প্রকাশ করার দক্ষতা আমার নেই। নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। অনেক ভাললাগা নিয়ে অবশেষে সান্দাকফুকে বিদায় জানালাম।

আজ ১৭ কিমি নীচে নামতে হবে। এই রাস্তাও ভীষণ সুন্দর। গুরাশ আর পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আর মাঝে মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ গাছের নীচে বরফ দেখলাম। বেশ কিছুটা যাবার পরে অনেকগুলো ইয়াক দেখতে পেলাম। দূর থেকেই তাদের ছবি নেওয়া হল। এইভাবে আমরা পুরো রাস্তাটা কখন হেঁটে ফেল্লাম, পৌঁছে গেলাম মোল্লের গেষ্টহাউসে। আমিতো জায়গাটা দেখেই বাকরূদ্ধ হয়ে গেছি। বুদ্ধদেব গুহ'র উপন্যাসে পড়া বনবাংলোয় যেন পৌঁছে গেছি। গরম গরম সুপ খেয়ে পথের ক্লান্তি দুর হয়ে গেল। এখানে জলের খুব কষ্ট, আর বিদ্যুতও নেই। দুপুরে সরষে সাক, ডাল আর ভাত খেয়ে নিলাম পেট পুরে। অনেকেই আজ ক্লান্ত, যে যার বিছানায় তাই গড়িয়ে নিচ্ছে। রাত্রে খিচুড়ি খাবার পর তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। প্রথমে কিছুক্ষণ বরফ বৃষ্টিও হল। ছুটে দেখতে গেলাম বাইরে, ঘন অন্ধকারে টর্চ নিয়ে। আমি যায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছি। আর দুটো দিন এখানে কাটিয়ে গেলে মন্দ হয়না, কিন্তু তা যে হবার নয়।

আজ যাব "শ্রীখোলা"। আজ আমাদের সাথে গাড়ি নেই। সঙ্গে দুজন পোর্টার আর ঘোড়া আছে। তাই আজ আমার পিঠে স্যাক রয়েছে, তাই সত্যিকারের ট্রেকার মনে হচ্ছে নিজেকে। পথে যেতে যেতে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে শেষবারের মত ভালভাবে দেখে নিলাম। আর দেখা যাবে না। আমাদের গাইড যে পথ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছেনা এ রাস্তা কোনদিন শেষ হবে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি, এই জঙ্গলই নাকি হিমালয়ান রেড পান্ডার বাসস্থান। খুব সাবধানে হাঁটছি ,খাড়া পাহাড়ী পথে ওঠার চেয়ে নামা বেশি কষ্টকর। প্রতি মুহুর্তেই মনে হচ্ছে পড়ে যাব। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে কখন একটা গ্রাম দেখা যাবে, কিন্তু আশে পাশে কোন জনবসতির দেখা নেই। দীর্ঘ উতরাই পেরিয়ে একটি পাহাড়ি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। গ্রামের নাম 'বিজগ্রাম'। ঝরনার মিষ্টি জল পান করে আবার চলা শুরু হল। মটর ও নানাবিধ সব্জি ক্ষেতের পাশ দিয়ে অনেকটা হাঁটার পর নদীর কল কল শব্দ কানে এল। আমরা শ্রীখোলা পৌঁছে গেলাম মনে হচ্ছে। যখন আমরা হোটেল শোভরাজে পৌঁছলাম, ততক্ষণে দলের অনেকেই পৌঁছে গেছে। নেপালি ভাষায় খোলা মানে নদী, আর এই নদীর নাম শ্রী বা ছিরি। সেইথেকেই এই যায়গার নাম হয়েছে শ্রীখোলা। দুচারদিন ছুটি কাটানোর জন্য শ্রীখোলা একটি আদর্শ যায়গা। সারাদিন নদীর জলে পা ডুবিয়ে কোথা দিয়ে কেটে গেল। রাতে তো দারুণ খাওয়া হল। ভাত,ডাল,সব্জি সাথে দিশী মুরগির ঝোল।

আমাদের সান্দাকফু ভ্রমণ শেষ। পরদিন সকালে রিম্বিক হয়ে আমরা দার্জ্জিলিং চলে গেলাম। যাবার সময় মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। সাতদিন একসঙ্গে থেকেছি, ঘুরেছি, এখন সেই স্মৃতি নিয়ে দার্জ্জিলিং ঘুরে আমরা কলকাতা ফিরব।

নীচের স্লাইড শো'তে কিছু ছবি দেওয়া হল :
Photobucket





লেখিকা : ঝুমা মুখার্জী
৩১শে জুলাই, ২০০৮
মথুরা, ইন্ডিয়া

6 comments:

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

darun romanchokor bornona.
Shange bhalo kichhu chhobir slide show.
Shob miliye hariye giyechhilam Himalaye.

shraddha.

Asim said...

Priya Jhuma,
Tomaar himaalayer paadadesher bhraman brittaanta parhe khub aananda peyechhi. Himaalay aamaar bheeshhan priya aar er nana dik diye porashuna korte ei niye nana abhijaan, bhramaner katha pora aamaar best pasttime. Tumi tomaader jaatrar bibaran shurui karechha khub sundar bhaabe. Jebhaabe Sandaakphu jaabaar puro raastaar barnana diyechha ekkathay asadharan. Tomaar chokhe Kaangchenjunga, Everest, Lotser sei aashcharjya soorjyaloke udbhasita chhabir katha pore aami spell bound. Eidharaner lekhai chai tomaader kaachh theke. Saabaas aar ajasra abhinandan.

Soma Banerjee said...

tomar sandakphu jabar barnona ashadharon laglo... eidik ta amar o khub priyo jayga... tai tomar lekha pore abar o sei ichhe ta nara dilo

Anonymous said...

Jhuma .. tomar lekha porte poret mone hochilo chole jai okhane .. erokom beranor golpo sune ki r ghore bose thakte ichhe kore

jhum said...

osadharon jhuma. eto romanchokor ovijan mone hocchilo amio tomar songe songe cholechi sandakofur pothe. ar vabtei parchina tumi tomar oto tuku konya ke niye eirom durgom sthane jabar sahos dekhiyecho. tumi je darun sahosi seta khub valo vabe bujhte parchi.osadharon laglo himalay bhromon tomar sathe.

Unknown said...

ebar mone hochhe amar berono r ei lekha sarthok hoechhe.